গরু কেনার সামর্থ্য নেই, তাই সংসার চালাতে নিজেরাই ঘানি টানেন দরিদ্র খর্গ মোহন সেন ও রিনা রানী সেন দম্পতি। ১২৫০ গ্রাম তেল উৎপাদনে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের গুয়াবাড়ি কিসামত এলাকার মধ্যবয়সী এ দম্পতির ঘানির জোয়ালে হাঁটতে হয় ৮ থেকে ৯ কিলোমিটার। একদিন ঘানি না ঘোরালে সংসারের চাকা ঘোরে না তাদের। ঘানি টেনে চলছে তাদের জীবনযুদ্ধ।

দেশি সরিষা পিষে তেল বের করার যন্ত্রকে ঘানি বলা হয়। সাধারণত ঘানি টানার জন্য কলুরা গরু ব্যবহার করেন।

দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে খর্গ মোহন সেন ও রিনা রানী সেন দম্পতি কাঠের তৈরি কাতলার ওপর প্রায় ৪৫০ কেজি ওজন বসিয়ে ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে ঘানি টেনে আসছেন। ঘানির তেল বাজারে বা গ্রামে বিক্রি করতে পারলেই সংসার চলে এ দম্পতির।

মোহন-রিনার তিন ছেলে ও এক কন্যাসন্তান রয়েছে। ভিটাবাড়িটুকুই সম্বল তাদের। মানুষকে নির্ভেজাল তেল খাওয়াবেন বলে বংশপরম্পরায় তেল ভাঙার এ পেশায় আছেন তারা।

আমাদের আপডেট জানতে ফলো করুন: ক্লিক করুন

মোহন সেন জানান, মেশিনের তৈরি সরিষার তেলের দাম বাজারে কম। ঘানি ভাঙা তেলের দাম বেশি। সাধারণ মানুষ বেশি দামে ঘানির তেল কিনতে চায় না। যারা ভেজালমুক্ত ঘানি ভাঙা খাঁটি সরিষার তেল কেনেন, সংখ্যায় তারা একবারে খুবই কম।

জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের গুয়াবাড়ি কিসামত গ্রামে একসময় অনেক পরিবারের ঘানি ছিল। কালের বিবর্তনে আর ইঞ্জিলচালিত যান্ত্রিক চাকার কারণে ঘানিশিল্প এখন প্রায় বিলুপ্তের পথে। গুয়াবাড়ি কিসামত গ্রামে একটি বাড়িতে এখন মাত্র একটি ঘানি রয়েছে। খর্গ মোহন ও রিনা রানী সেই ঘানির জোয়াল টানেন। একসময় তারা ঘানি ভাঙা ৬ থেকে ৭ কেজি তেল উৎপাদন করতে পারতেন। বয়সের কারণে আগের মতো শরীরের শক্তি নেই। ১ থেকে ২ কেজি তেল উৎপাদন করতে পারলে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে কোনোরকমে সংসার চালান এখন। বয়সের ভারে মাঝেমধ্যে শরীর ভালো থাকে না। সে সময়টা দরিদ্র সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় এক মুঠো ভাতের জন্য।

আমাদের খবর ভিডিও আকারে পেতে সাবস্কাইব করুন: ক্লিক করুন

গুয়াবাড়ি কিসামত গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, রিনা খর্গ মোহন বাড়ির বারান্দায় বসে তেল মেপে দিচ্ছেন এক যুবককে। পাশের একটি ছোট্ট ভাঙা ঘরে ঘানি টানছেন রিনা রানী সেন। প্রতিদিন ৪ থেকে ৬ কেজি সরিষা ভাঙতে পারেন তিনি।

একই এলাকার অশেষ রায় বলেন, একসময় এ গ্রামে অনেক ঘানি ছিল, এখন নেই বললেই চলে। এই একটি বাড়িতেই রয়েছে। খর্গ মোহন সেন এর পরিবার অভাবগ্রস্ত, গরু কেনার সামর্থ্য নেই। ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে স্বামী-স্ত্রী হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন।

রিনা রানী সেন বলেন, ‘টাকার অভাবে গরু কিনতে পারি না, স্বামী-স্ত্রী নিয়ে এক জোয়াল টানি, একদিন জোয়াল টানতে না পারলে খাব কী? বয়স হচ্ছে, আগের মতো পারি না, দুটি না হলেও একটি গরু থাকলেও এমন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম স্বামী-স্ত্রীর করতে হতো না। মাঝেমধ্যে আমার বড় ছেলে ঘানি টেনে সহযোগিতা করে।’

খর্গ মোহন সেন বলেন, ‘আগের মতো দেশি সরিষা পাওয়া যায় না, গ্রামে ঘুরে ঘুরে সরিষা সংগ্রহ করি, তার পরও দাম বেশি। বাপ-দাদার সঙ্গে জোয়াল (ঘানি) টানতে টানতে অন্য কোনো পেশা শিখতে পারিনি। প্রায় পাঁচ যুগ ধরে নিজে জোয়াল টানছি। এখন আর শরীর চলে না, স্ত্রীর সঙ্গে বড় ছেলে জোয়াল টানে। একটি গরু থাকলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বংশপরম্পরায় পেশাটি ধরে রাখতে পারতাম।

পোষ্টটি লিখেছেন: admin

এই ব্লগে 152 টি পোষ্ট লিখেছেন .

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *