রংপুরসহ সারা দেশে প্রায় দেড় বছর পর স্কুল-কলেজের আঙিনায় পা পড়েছে শিক্ষার্থীদের। হিসাব কষলে ৫৪৪ দিনের অপেক্ষার পর। তবু সবার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। এতদিন পর সহপাঠী বন্ধুর সঙ্গে দেখা, একজন আরেকজনকে আলিঙ্গন করা থেকে দূরে থাকলেও এ যেন অন্যরকম এক অনুভূতি। কিন্তু এই হারিয়ে যাওয়া আনন্দের মাঝে রয়েছে অনেক বিধিনিষেধ। মানতে হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি। ক্লাসে ঢুকেই শুনতে হয়েছে সচেতনতার বার্তা। তবু তারা বিদ্যালয়ের পরিবেশে ফিরে এসে আনন্দিত।
সরেজমিনে রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) রংপুর নগরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এমন দৃশ্যই দেখা গেছে। সকাল থেকেই রাস্তায় ছিল শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। কেউবা পথ ধরে হেঁটে হেঁটে, আবার কেউ ছিল অভিভাবকের সঙ্গে। সহপাঠীরা দল বেঁধে। তাদের পরনে স্কুল পোশাক। আবার রিকশা, মোটরসাইকেল, অটোরিকশাসহ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে শিক্ষার্থীরা পৌঁছায় প্রিয় শিক্ষাঙ্গনে। তাদের মুখে ছিল মাস্ক, ব্যাগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এদিকে বহুদিন পর তাদের বরণে ব্যস্ত ছিলেন শিক্ষকরা। আর অভিভাবকরা বিদ্যালয়গুলোর আশপাশে মেতে ওঠেন খোশগল্পে।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রংপুর নগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে আরও দেখা গেছে, প্রচণ্ড রোদ-গরম উপেক্ষা করেই শিক্ষার্থীরা সময়মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ছিল আনন্দের রেশ। চেহারায় ছিল খুশির ঝিলিক। অনেক দিন পর বন্ধু-সহপাঠীদের মধ্যে দেখা হওয়ার আনন্দ। অনেককেই জড়ো হয়ে গল্প করতে দেখা গেছে। তবে মুখে মাস্ক পরা ছাড়াও করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে তাদের সতর্ক থাকতে দেখা যায়।
রংপুর জিলা স্কুলের সামনে সকাল আটটায় দেখা যায়, স্কুলে প্রবেশের সময় মাস্ক আছে কি না, সেটি যাচাই করা হচ্ছে। ভালো করে হ্যান্ড স্যানিটাইজ করা এবং শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী ভিড় এড়াতে বিদ্যালয়ে অভিভাবকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া স্কুল প্রাঙ্গণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষের ভেতরেও সামাজিক দূরত্ব রেখে শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল বসার ব্যবস্থাও।
শুধু তা-ই নয়, পাঠদান শুরুর আগেই সংক্রমণ ঝুঁকি রোধে শোনানো হয় সচেতনতার বার্তা। একই চিত্র ছিল, রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রংপুর উচ্চবিদ্যালয়, আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ও এর আশপাশ।
রংপুর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, সরকারের নির্দেশনা মেনে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করার সঙ্গে সচেতনতার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রথম দিন হিসেবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক।
নগরীর কলেজ রোড চারতলার মোড়ের সফুরা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষার্থীদের ফুল এবং চকলেট দিয়ে স্বাগত জানাতে দেখা গেছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপার পাশাপাশি হাত জীবাণুমুক্তকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন পর শিশু শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে হতে পেরে আনন্দে মেতে উঠেছিল। তবে বিধিনিষেধের কারণে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরা বা করমর্দন করার সুযোগ পায়নি। অন্যান্য দিনের মতো স্কুলটির সামনে ঝালমুড়ি, চানাচুরসহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের ভ্রাম্যমাণ দোকান বসতে দেখা যায়নি।
দীর্ঘদিন পর স্কুলে ফিরতে পেরে এই প্রতিষ্ঠানটির শিশু শিক্ষার্থীরা ছিল বেশ উচ্ছ্বসিত। পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া সুমাইয়া বিনতে ইরা বলে, খুব ভালো লাগছে। কতদিন পর বাসায় ছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়নি। আজ স্কুলে এসে আমি আনন্দিত। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, গল্প করব। স্কুলের দোলনায় খেলা করব।
সফুরা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের আয়া জমিলা খাতুন বলেন, আমরা খুব আনন্দিত। অনেক দিন পর একসঙ্গে সবাইকে দেখতে পারছি। আমি আজ দেড় বছর পর ঘণ্টা বাজালাম। ছোট বাচ্চাদের চোখেমুখে আনন্দের ছাপ। আমাদের স্কুলের সব স্যার-ম্যাডাম টিকা নিয়েছেন। আমি চাই স্কুল খোলা থাকুক।
একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক জান্নাতুন নাহার জেবা বলেন, প্রথম দিনে সবার কাছে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাসে আসার বিষয়টি তুলে ধরেছি। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও এ নিয়ে বলা হয়েছে। তবে অনেকবার খুলবে খুলবে করেও স্কুল না খোলায় হতাশ ছিলাম। কিন্তু আজ স্কুলে এসে মনের মধ্যে একটা অন্যরকম শান্তি অনূভব করছি।
আদর্শ কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ আব্দুল মালেক জানান, স্কুল খোলার ১৯ দফা শর্ত জুড়ে দেয় সরকার। এসব শর্ত মেনে পাঠদানের পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি রোধে আমরা নিজেরাও সতর্কতা অবলম্বন করছি। পাশপাশি ছাত্রছাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মানছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করছি।
এদিকে রংপুরের দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোরদের স্কুল খোলা নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। ইউসেফ স্কুলসহ বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। একই চিত্র ছিল করোনার এই পতিত সময়ে হতদরিদ্র পরিবারের কর্মজীবী শিশুদের বেলায়ও। স্কুলে নাম থাকলেও এসব শিক্ষার্থীকে স্কুলের বদলে দেখা গেছে কর্মক্ষেত্রে।
প্রসঙ্গত, ১৯ দফা শর্ত দিয়ে স্কুল খোলার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। শর্ত অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থানের সময় শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাইকে সব সময় মাস্ক পরতে হবে। শিক্ষার্থীদের তিন ফুট শারীরিক দূরত্বে রাখা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করার কথা আছে। শ্রেণিকক্ষে পাঁচ ফুটের চেয়ে ছোট আকারের বেঞ্চিতে একজন ও এর চেয়ে বড় আকারের বেঞ্চিতে দুজন শিক্ষার্থী বসানো।
এ ছাড়া প্রথম দিকে পাবলিক পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরাই বেশি আসবে। বাকিদের স্কুলে আসার ক্ষেত্রে রোটেশন সিস্টেম অর্থাৎ আজ যারা আসবে, তারা কাল আসবে না, এই নীতি অনুসরণ করতে হবে। তবে এসব শর্ত ঠিক মানা হচ্ছে কি না বা স্কুল খোলার পর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি কেমন হয়, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে সরকার।